এসএসসি এসাইনমেন্ট ২০২১ সমাধান/ উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা (৭ম সপ্তাহ) এসাইনমেন্ট -৫
ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ শীর্ষক প্রবন্ধ
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় । ভাষা , নৃতত্ত্ব , ইতিহাস , ঐতিহ্য , সংস্কৃতি , ভৌগােলিক পরিবেশ , খাদ্যাভ্যাসসহ সকল ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে এক হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করে এই অসম রাষ্ট্র গড়ে তােলা হয় । এই রাষ্ট্রের কর্ণধাররা প্রথমই শশাষণ ও বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলাকে । অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় পাকিস্তানের ভাষাগত জনসংখ্যার একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে , মােট জনসংখ্যার ৫৪.৬০ % বাংলা , ২৮.০৪ % পাঞ্জাবি , ৫.৮ % সিন্ধি , ৭.১ % পশতু , ৭.২ % উর্দু এবং বাকি অন্যান্য ভাষাভাষী নাগরিক এর থেকে দেখা যায় উর্দু ছিল পাকিস্তানি ভাষাভাষির দিক থেকে ৩ য় স্থানে । অন্যদিকে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার ৪.৪০ কোটির মধ্যে ৪১৩ কোটি ছিল বাংলা ভাষাভাষী । এখানে ৯৮ % বাংলা এবং মাত্র ১.১ % ছিল উর্দু ভাষী । অথচ বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বেশ কিছু পরিকল্পনা নেয় । কিন্তু সংগ্রামের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি জাতি মাতৃভাষার ওপর এ আঘাতের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে । পাকিস্তান সৃষ্টির ছ'মাস পেরুতে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রাজপথে নামে যা ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় পর্বের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করে ।
ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ছিলেন । তিনি দেশ বিভাগের পর কলকার্তা থেকে ঢাকায় আগমন করেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় হন । ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয় অংশগ্রহণ , জোরালাে সমর্থন দেওয়া ও নীতিনির্ধারণী নানা বিষয়ে সাহায্য করেন । তিনি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন । ওই সময়ে বিভিন্ন মিটিংয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আয়ােজিত বিভিন্ন মিছিলে নেতৃত্ব দেন । ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাকুে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন ।
তিনিই প্রথম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সুস্পষ্ট বক্তৃব্য প্রদান করেন । তিনি বলেন , সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা ঠিক করবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ । সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করার জন্য তিনি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীকে আহ্বান করেন । বঙ্গবন্ধু ৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে এবং মিছিল শেষে সভায় অসাম্প্রদায়িকু রাজনীতির যে দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেছিলেন , তারই সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন মাত্র দু'বছরের মধ্যেই । সারাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রােতাে ধারার সৃষ্টি করেছিলেন , যার পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে , যার ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ ; বাহাত্তর সালে বাংলাদেশের সংবিধান , ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি ঘােষণা , সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নির্বাসন । বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন করেছিলেন , ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন । তার চিন্তা - চেতনায় ছিল মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি বিধানের সংকল্প । বাঙালিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এ চেতনা ছিল সর্বদা সক্রিয় । এ ব্যাপারে তিনি আমৃত্যু ছিলেন আপসহীন , কঠোর । বাঙালি জাতি তার এই অনন্য সাধারণ ভূমিকার কথা কখনাে ভুলবে না ।
ভাষা আন্দোলনে অন্যান্য নেতৃত্তঃ
২১ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ঠিক কতজন মারা গিয়েছে তা নিয়ে পরবর্তীকালে নানা কারণে মতভেদ দেখা দিয়েছে । ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি লেগে কেউ আবার পরে মৃত্যুবরণ করেছেন । শেষপর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া / গেছে ভাষার কারণে ৬ জন শহীদ হয়েছিলেন । শহীদ রফিকউদ্দীন আই.কম. পড়তেন । তাঁর বয়স উনিশ / বিশ ছিল । তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জ । আবুল বরকত ১৯২৭ সালের ১৬ জুন জন্মগ্রহণ এবং ১৯৪৫ সালৈ ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন । ১৯৪৮ সালে তিনি পাকিস্তানে আসেন । তার পিতার নাম শামসুজ্জোহা । শহীদ শফিউর রহমান ছিলেন হাইকোর্টের কর্মচারী । ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তার জন্ম । এঁদের তিনজনকেই আজিমপুর দাফন করা হয় । শহীদ আব্দুল জব্বার ছিলেন পেশায় দর্জি । গফরগাঁওয়ের পাচাইয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি । শহীদ অলিউল্লাহর বয়স ৮/৯ বছর । তিনি রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে । আবদুস সালাম ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল মারা যান । তিনি পেশায় পিয়ন ছিলেন ।
ভাষা আন্দোলনে নারী
আটচল্লিশ ও বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন এদেশের নারী সমাজের প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল । মিছিল , শ্লোগান , সভা - সমিতিতে তারাও পুরুষের পাশাপাশি সংগ্রাম করেছেন । ঢাকার বিভিন্ন স্কুল - কলেজ , বিশেষ করে কামরুন্নেসা স্কুল এবং ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল সংগ্রামী । মিছিল মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে নাদিরা চৌধুরীসহ আরও অনেকে পােস্টার , ফেস্টুন লিখন এবং নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন । ঢাকার বাইরেও নারী সমাজের ভূমিকা ছিল সক্রিয় এবং প্রতিবাদী । যশােরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন হামিদা রহমান । বগুড়ার বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন রহিমা খাতুন , সালেহা খাতুনসহ অনেকে । ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারীদেরও ব্যাপক ভূমিকা ছিল । এ আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা রাখেন শাহেরা বানু , লুৎফুন্নেছা রাবেয়া খাতুনসহ আরও অনেকে পােস্টার ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন সচল রাখার তৎপরতা চালানাের সময় ১৯৪৯ সালের ১৩ ই আগস্ট গ্রেফতার হন লিলি চক্রবর্তী । এসব সংগ্রামী ভূমিকার পাশাপাশি ঐ সময় বিভিন্ন স্থানে নারীরা ভাষা আন্দোলনকারীদের সহযােগিতা করেন । তাঁদের মধ্যে নিবেদিতা নাগ , সারা তৈফুর মাহমুদ , সাহেরা বানু উল্লেখযােগ্য ।
জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য
১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে । পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে এটি ছিল বাঙালি জাতির প্রথম বিদ্রোহ । ভাষা আন্দোলন তঙ্কালীন রাজনীতি , সমাজ , অর্থনীতি , সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় ।
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ : ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মর্যাদার জন্যই গড়ে ওঠেনি । পাকিস্তানের মাত্র ৭.২ % জনগণ ছিল উর্দু ভাষাভাষী । পক্ষান্তরে ৫৪.৬ % জনগণের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা বাঙালি স্বভাবতই মেনে নিতে চায় নি।এর সাথে তাদের জীবিকার্জনের প্রশ্নও জড়িত ছিল।অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায় হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠাকে তারা বেছে নেয় । এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাই ষাটের দশকে স্বৈরশাসন বিরােধী ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আন্দোলনে প্রেরণা জোগায় ।
২. অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ : ভাষা আন্দোলনের ফলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ঘটে । দ্বিজাতিতত্ত্বের ধর্মীয় চেতনার মূলে সংশয় দেখা দেয় । পাকিস্তান সৃষ্টির সাম্প্রদায়িক ভিত্তি ভেঙ্গেবাঙালিরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্দোলন শুরু করে । ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্যের সমর্থনে ১৯৪৮ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । গণপরিষদে হিন্দু সদস্যদের ভাষার পক্ষে যে কোন প্রস্তাব - বক্তব্যের বিরােধিতা করেন মুসলিম সদস্যরা । মুসলিম লীগ ও শাসকচক্র চিরাচরিত ঐতিহ্যানুযায়ী ধর্মকে ব্যবহার করে ভাষা আন্দোলনকারী ও সমর্থকদের ভারতের দালাল ' , ' অমুসলিম ' , ' কাফের ' বলে চিহ্নিত করেও আন্দোলন থামাতে পারেনি । ফলে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই তোরওয়ামী দীর্ঘদিন পর হিন্দু - মুসলিম সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় । মুসলিম লীগ নামক বৃহৎ রাজনৈতিক দল তাদের দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করে ।
৩.রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় ৪ টি পৃথক ভাবাদর্শ ভিত্তিক রাজনৈতিক ধারা লক্ষণীয় ছিল-
১. মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগ । মুসলিম লীগ আবার চারটি উপদলে বিভক্ত ছিল ক . নাজিমুদ্দিন - আকরাম খ গ্রুপ ; খ . সােহরাওয়ার্দীহাশিম গ্রুপ ; গ . এ.কে. ফজলুল হক গ্রুপ ; ঘ . মাওলানা ভাসানী গ্রুপ । প্রথম উপদলটি ছিল কট্টর ও উর্দুর পক্ষে । বাকি উপদলগুলাে | ছিল বাংলার পক্ষে । ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই বাকি তিনটি উপদলই মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে ।
২. আংশিক ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় কংগ্রেস , এদের তেমন প্রভাব না থাকলেও এরা ছিল বাংলার পক্ষে ।
৩. বিপ্লবী সাম্যবাদী ভাবধারার প্রতিনিধিত্বকারী কমিউনিস্ট পার্টি ।
৪. মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা প্রগতিশীল গণআজাদী লীগ । এরূপ রাজনৈতিক বিভাজন রাজনীতিতে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক মেরুকরণ ঘটায় ।
৪. রাজনীতি থেকে মুসলিম লীগের চির বিদায় :
ভাষা আন্দোলনে বিরােধিতা , স্বৈরশাসন , বাঙালির অধিকারের প্রতি উপেক্ষা সর্বোপরি দলের নেতাদের শ্রেণী চরিত্রের কারণে এ দলটি জনবিচ্ছিন্ন হতে সময় লাগে নি ।১৯৫২ সালেই আওয়ামী লীগ , গণতান্ত্রিক দল , ছাত্র ইউনিয়ন , পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মুসলিম লীগ বিরােধী জোট গঠনের সূচনা করে । ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী মুসলিম গীগ , কৃষক - শ্রমিক পার্টি , নেজামী ইসলামী মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে । কমিউনিস্ট পার্টি ফ্রন্টে যােগ না দিলেও কেউ কেউ আওয়ামী মুসলিম লীগের টিকেটে প্রার্থী হন । সমাজবিজ্ঞানী রঙ্গলাল সেন লিখেছেন যে , ১০ জন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য আওয়ামী মুসলিম লীগের পরিচয়ে সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন । নির্বাচনে ভাষা আন্দোলনের সমর্থক যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়যুক্ত হয় । ৩০৯ টি আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র ১০ টি আসন লাভ করে মুসলিম লীগের মুখপত্র দৈনিক আজাদ ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির জন্য যে ১০ টি কারণ চিহ্নিত করে তার প্রথমটি ছিল “ বাংলা ভাষার দাবির প্রতি অবিচার , ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নুরুল আমীন সরকারের দমননীতি । ”
৫. জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা : ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহলে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৫২ সালের আন্দোলন ব্যাপক জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলে । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় তা অকার্যকর হয়ে পড়ে । স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে পরের দিনের গায়েবানা জানাজার পর ঢাকা শহরের পরিস্থিতির ওপর কারাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না । কারাে নির্দেশ ছাড়াই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মহল্লা , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল রাজপথে নেমে পড়ে । পুলিশের সাথে জনতার বহু স্থানে সংঘর্ষ হয় । সারা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহর ছিল প্রতিবাদ মিছিল আর হরতালের শহর । ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর মফস্বলে ছড়িয়ে পড়লে সেখানেও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ , সমাবেশ হয় ।
৬. কুসংস্কার ও গোড়ামিতে আঘাত : তখন সমাজ অত্যন্ত রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেয়েরা রক্ষণশীলতার প্রাচীর পেরিয়ে রাস্তায় নামে । ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অনেক ছাত্রীই প্রথমে গােপনে পোেস্টার লিখে , চাদা দিয়ে সহযােগিতা করতাে । অবশ্য ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অনেক মেয়ে সরাসরি মিছিল , মিটিং - এ ছেলেদের সঙ্গে অংশ নেন । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম শােভাযাত্রায় মেয়েরাই প্রথম ছিলেন । ১৯৪৮ সালে যশাের ভাষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন হামিদা রহমান । নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের অগ্নিকন্যা ছিলেন মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগম । মিছিলে , সমাবেশে তিনি ছিলেন প্রথম সারিতে । এছাড়া চট্টগ্রাম , সিলেট , কুমিল্লা , দিনাজপুর , সৈয়দপুরে নারী সমাজের ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল । ভাষা আন্দোলনের ফলে এমনিভাবে প্রকাশ্যে মহিলাদের সভাসমিতিতে , মিছিলে যােগদান সমাজে নতুন চিন্তাধারার সৃষ্টি করে । ভাষা আন্দোলনের পর পর রাজনীতি , শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় ।
৭. বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি : ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারকে ভাবিয়ে তােলে । ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ পাকিস্তান গণপরিষদের বিবেচনার জন্য প্রেরণের একটি প্রস্তাব স্বয়ং মুসলিম লীগ পাস করে । যদিও গণপরিষদে তা বাধার সম্মুখীন হয় । ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের আগে এ বিষয় কোন অগ্রগতি হয়নি । যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মােতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি শােক দিবস হিসেবে ছুটি ও শহীদ দিবস ঘােষণা করে । এছাড়া একই বছর গণপরিষদ পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দু ও বাংলা এবং পার্লামেন্টেই ইংরেজী ছাড়াও উর্দু ও বাংলায় বক্তব্য রাখার বিধান করা হয়।অন্যদিকে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৮. বাংলা ভাষা চর্চা ও বিকাশ :
রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে সাহিত্য ও সাংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা নিশ্চিত হয় । এই পথ ধরেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয় । সম্ভব হয় সাংস্কৃতিক খন্ডিত ও বিকৃত করার চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত করে তােলার শক্তি ও সাহস।এতােদিন বাংলা সাহিত্যিকে সংস্কৃত ও হিন্দু প্রভাবিত বলার প্রয়াসের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ছিল জোরালাে প্রতিবাদ । কবি , সাহিত্যিক , সাংস্কৃতিক কর্মীরা নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হন । হাসান হাফিজুর রহমান , শামসুর রহমান , আলাউদ্দিন আল আজাদ , আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ , সৈয়দ শাসসুল হক ও আলাে অনেকে কাব্য ও সাহিত্য , ভাষা আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
৯. শহীদ স্মৃতির প্রতীক ও আন্দোলনের উৎস শহীদ মিনার তৈরি :
১৯৫২ সালেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় শহীদ মিনার । শুধু ঢাকায় নয় ঢাকার বাইরে রাজশাহী , চট্টগ্রাম , মানিকগঞ্জ , ময়মনসিংহ , গােপালগঞ্জ , দিনাজপুর , পাবনার শহীদ মিনার গড়ে ওঠে । এই শহীদ মিনার শুধু শহীদদের স্মৃতিকেই অমরত্ব দেয়নি , প্রতিষ্ঠিত করেছে এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য এক উদ্দীপনা।শহীদ মিনারই পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদ , বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ও আন্দোলনেরকেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সহ দেশের প্রায় সকল শহীদ মিনার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ।
১০. স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা :
ভাষা আন্দোলন ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও ক্রমে এর সাথে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়ে । ভাষা আন্দোলনকালে ও পরে বিভিন্ন লেখনি ও দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু বাংলাভাষা নয় বরং বাঙালিদের রাজনৈতিক , অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন দাবি উত্থাপিত হয় । গণপরিষদে পূর্ববাংলার জনসংখ্যানুপাতিক আসন , প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন , কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালি নিয়ােগ , পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটানাের দাবি করা হয় । যুক্তফ্রন্ট এসব দাবিকে প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসে । যা ষাটের দশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবিতে পরিস্ফুটিত হয় । এরপর ধারাবাহিকভাবে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে রূপ নেয় । স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে যা চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে । তাই বলা যায় যে , ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলন।
বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকায়নের পটভুমি তাৎপর্য
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরের বছর থেকে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির একুশে দিনটি বাঙালির শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে । বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাত ১২ টা এক মিনিটে রাষ্ট্রপতি , প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে ভাষাশহিদদের প্রতি পুস্পার্ঘ্য নিবেদন করেন । একুশের প্রভাতফেরি ও প্রভাতফেরির গান বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১ শে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করা হয় । এদিন শহিদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়ােজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি চেতনাকে লালন করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয় । ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতি রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করে । বিশ্বের ইতিহাসে অনন্যসাধারণ ঘটনা হিসেবে আমাদের ভাষা ও শহিদ দিবস আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ মাতৃভাষা দিবস ' হিসেবে ঘােষণা করা হয় । ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে এই দিনটি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা । পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে এটি ছিল বাঙালি জাতির প্রথম প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ , বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রেরণা । ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের অবহেলা , বঞ্চনা , শশাষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল । মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবমাননা বাঙালির মনকে প্রবল নাড়া দিয়েছিল । তারা বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানিদের হাতে তাদের ভাষা , সংস্কৃতি , অর্থনীতি কিছুই নিরাপদ নয় । এভাবেই বাঙালির মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপিত হয় ।
২০২১ সালের এসএসসি ৭ম সপ্তাহের বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা (এসাইনমেন্ট-৫) সমাধান/উত্তর
Tag: এসএসসি এসাইনমেন্ট ২০২১ সমাধান/ উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা (৭ম সপ্তাহ) এসাইনমেন্ট -৫, ২০২১ সালের এসএসসি ৭ম সপ্তাহের বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা (এসাইনমেন্ট-৫) সমাধান/উত্তর, ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ শীর্ষক প্রবন্ধ
Any business enquiry contact us
Email:-Educationblog24.com@gmail.com
(সবচেয়ে আগে সকল তথ্য,গুরুত্বপূর্ণ সকল পিডিএফ, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদেরGoogle News,FacebookএবংTelegram পেজ)